✍️লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
নারী—একটি শব্দ, যার ভেতরে লুকিয়ে থাকে সৃষ্টির অমোঘ সৌন্দর্য, সহনশীলতার নিরবতা, আর অন্তহীন শক্তির প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই নারীর জীবন কি শুধুই সৌন্দর্যের গাথা? সমাজের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, নারীর জীবন এক অব্যক্ত যন্ত্রণার ইতিহাস, যেখানে অসচেতনতা কেবল এক মানসিক বন্ধন নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে একটি প্রজন্মের অবরুদ্ধ সম্ভাবনা।
যেখানে আলো আছে, সেখানেই ছায়া। নারীর জীবনেও তেমনি রয়েছে অন্ধকারের স্তর, যা কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং শিক্ষা-অসচেতনতার জালে জড়িয়ে আছে। একটি গ্রামীণ দৃশ্যপটের কথা ভাবা যাক—কাঁচা রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট ঘর, যেখানে বসে আছে এক গৃহবধূ, তার মুখে ক্লান্তির রেখা, চোখে অনাগত ভবিষ্যতের শূন্যতা। সে জানে না নিজের অধিকারের কথা, জানে না স্বাস্থ্য সচেতনতার মৌলিক প্রয়োজনীয়তা। তার জীবন সীমাবদ্ধ রান্নাঘরের চার দেয়ালে, যেখানে সে দিনরাত মুছে যায় পরিবারের দায়বদ্ধতায়।
বেগম রোকেয়ার লেখা “সুলতানার স্বপ্ন” যেন এমন এক প্রতিবাদী উচ্চারণ, যেখানে নারী তার অসচেতনতার শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। রোকেয়ার স্বপ্নের সেই নারী কোনো গৃহকোণে বন্দি নয়; বরং আকাশের মতো বিস্তৃত, জ্ঞানের আলোকছটায় দীপ্ত। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে দূরত্ব তখনই তৈরি হয়, যখন নারী নিজেই নিজের ভেতরের আলোকে জ্বালাতে পারে না।
নারীর অসচেতনতার বিষয়টি কেবল শিক্ষার অভাবেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক জড়তা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গড়ে উঠেছে। সমাজ নারীর জন্য যে বাঁধন তৈরি করে, তা নারী নিজেই শিকল হিসেবে গ্রহণ করে ফেলে। যেন নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে চিনতে না পারার এক দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাস।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ‘বনলতা সেন’ এক রহস্যময় নারীচরিত্র, যার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সান্ত্বনা আর স্থিরতার প্রতীক। কিন্তু এই বনলতার দৃষ্টিতে কি কখনও ছিল কোনো জাগরণের আবেদন? নাকি সে কেবল পুরুষ কবির নিঃসঙ্গতার এক আশ্রয়স্থল? নারী কি কেবলই কারো নিঃসঙ্গতার নিরাময়, নাকি সে নিজেই হতে পারে এক বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি? এই প্রশ্নই জাগে যখন সাহিত্যের পাতায় নারীর অসচেতনতার ছায়া পড়তে দেখি।
নারীর জীবনে অসচেতনতার গ্লানি সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে থাকা নারীরা জানেই না কিভাবে নিজেদের জন্য লড়াই করতে হয়। একটি কন্যাশিশু যখন জন্ম নেয়, তখন থেকেই তার চারপাশে তৈরি হতে থাকে এক অদৃশ্য প্রাচীর—এই প্রাচীর কখনো পরিবারের কড়াকড়ি, কখনো সমাজের গোঁড়ামি, আবার কখনো নিজের অন্তর্গত ভীতি।
কিন্তু নারী কি শুধুই এই অসচেতনতার প্রতিচ্ছবি? না, নারী হলো সেই অগ্নিশিখা, যা নিভে গেলেও তার উষ্ণতা থেকে যায়। তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে আলোর সেই কণা, যা জাগ্রত হলে সমাজের অন্ধকার দূর হয়ে যায়। সাহিত্য বারবার সেই কথাই বলে। সেলিনা হোসেনের “হাঙর নদী গ্রেনেড”-এর নারী চরিত্রগুলো যেন সময়ের নির্দিষ্ট ফ্রেমে বন্দি থাকলেও, তাদের ভেতরের জাগরণ অদম্য।
নারীর অসচেতনতা কেবল তার ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি সমাজের ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত। একটি মেয়েকে যখন শেখানো হয় শুধু সংসার সামলানোই তার জীবনের লক্ষ্য, তখনই তার ভেতরের জাগরণের আলো নিভে যায়। কিন্তু সেই আলো আবার জ্বালানো সম্ভব, যদি তার ভেতর থেকে জেগে ওঠে নিজের পরিচয় খোঁজার তীব্র বাসনা।
আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সমাজে যত প্রগতির ঢেউই আসুক না কেন, নারীর আত্মজাগরণ ছাড়া সেই প্রগতি অপূর্ণই থেকে যায়। সাহিত্য আমাদের শেখায় কিভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়, কিভাবে নিজের ভেতরের অন্ধকারকে আলোর দিকে ঠেলে দিতে হয়। তাই নারীর জাগরণ মানে কেবল একজন নারীর জেগে ওঠা নয়; এটি একটি পরিবার, একটি সমাজ, এমনকি একটি জাতির জেগে ওঠা।
নারী যখন জেগে ওঠে, তখন তার অসচেতনতার গ্লানি মুছে যায়। তখন সে হয়ে ওঠে এক জীবন্ত কবিতা, যেখানে প্রতিটি শব্দই একটি নতুন সম্ভাবনার বার্তা। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে হলে নারীকে প্রথমে নিজের অজানা জগৎটাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে তার ভেতরের শক্তিকে।
কারণ নারী কখনও কেবল একটি সম্পর্কের সংজ্ঞা নয়, সে নিজেই একটি পূর্ণ গল্প। একটি জাগ্রত সত্তা।
❝নারীর জাগরণ
যবে নারীর চোখে জ্বলে জ্ঞানের দীপ্তি,অন্ধকার সমাজ পায় নব আলোর সত্ত্বি।
চেতনার স্পর্শে ভাঙে সকল বাঁধন,
আলোকিত হয় পথ, জাগে নতুন প্রাণ।❞
লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো মিশর