বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কয়েকমাস আগে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করার মতো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার।
সেই অনুযায়ী প্রতিবছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রতি রাতে গড়ে দুই হাজার করে পর্যটক থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো এই প্রবাল দ্বীপটিতে।
নভেম্বর মাসে শুধু দিনের বেলায় সেন্টমার্টিনে ঘোরার অনুমতি ছিল।
রাতে এই দ্বীপে অবস্থানের সুযোগ শেষ হচ্ছে ৩১শে জানুয়ারি। এরপরের নয় মাস ভ্রমণের জন্য সেন্টমার্টিনে যাওয়া যাবে না।
কিন্তু সরকার যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ওই নিয়ম জারি করেছিলো বাস্তবে তা অর্জন করা কতটা সম্ভব হলো?
সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধে সেন্টমার্টিনে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি?
বিধিনিষেধ
গত বছরের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পর্যটকেরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারলেও রাতে থাকতে পারবেন না। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গিয়ে রাতে থাকতে পারবেন।
তবে শর্ত হলো, ওই দুই মাসে দৈনিক গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোনও পর্যটকই সেখানে যেতে পারবেন না।
যদিও শুরু থেকেই সেখানকার মানুষ ও ব্যবসায়ীরা সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে।
সেন্টমার্টিনকে কেন্দ্র করে যাদের জীবন-জীবিকা, তারা জানুয়ারির শেষে এসে এখনও আশা করে আছেন যে সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।
৩০শে জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একে আহসান উদ্দীন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, "ব্যবসায়ীরা এক মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মানববন্ধন করছেন।"
কিন্তু সরকার শুরুতেও যেমন তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল, এখন পর্যন্ত তারা তা-ই আছে।
মি. উদ্দীনও বলেছেন, "সময় বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি এখনও।"
তবে অক্টোবরে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, "আমরা দ্বীপটি বাঁচাতে চাই। এটি সবার সম্পদ। পর্যটকরা দায়িত্বশীল আচরণ করলে দেশের ওই সম্পদ রক্ষা পাবে।"
সরকার তখন সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ব্যাপারে নানা শর্ত জুড়ে দেয়। যেমন– তখন বলা হয় যে সেখানে কোনো আলোকসজ্জাসহ বারবিকিউ পার্টি করা যাবে না। আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই দ্বীপের প্রবালসহ সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, পর্যটকদের মাধ্যমে বা অনুমোদিত জাহাজে করে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিবহন করা যাবে না।
এগুলোর বাইরে আরও বলা হয়, পর্যটকরা কোন হোটেলে অবস্থান করবে তার রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অ্যাপ থেকে সংগ্রহ করা ট্রাভেল পাসধারী পর্যটকদের অনুমোদিত জাহাজে ভ্রমণ নিশ্চিত করতে হবে।
তবে আইইউসিএন বাংলাদেশের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপুও বলেন, "যেভাবে বলা হয়েছিল, সেভাবে ট্রাভেল পাস ব্যবহার হচ্ছে না। তবে মানুষ কম যাচ্ছে, এটি সত্য।"
পর্যটকদের অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনে সপরিবারে ঘুরতে গিয়েছিলেন জাকিয়া আহমেদ। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় সেন্টমার্টিন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
তিনি শুরুতেই বলেন, জাহাজে অনেক ভোগান্তি হয়েছে। স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়েও অনেকে এবার সেন্টমার্টিনে গেছেন বলে জানান তিনি।
পর্যটন সীমিতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো। কিন্তু "বিচের কোথাও কোনো বিন নেই" বলে উল্লেখ করেন মিজ আহমেদ।
"ওখানে যে পরিমাণ খাবারের দোকান, সবারই কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিন না থাকায় পুরো বিচ জুড়ে চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, বোতল, সিগারেটের প্যাকেট পড়ে থাকে।"
সেন্টমার্টিনে যারা-ই যান, তারা সাধারণত বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ভূখণ্ড ছেঁড়াদ্বীপও ঘুরে আসতে চান। যদিও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যেখানে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে।
তবে মিজ আহমেদ তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান, এই নিষেধাজ্ঞারও কোনো বাস্তবায়ন নেই।
"আমি নিজে সেখানে যাইনি। কিন্তু আমি যে রিসোর্টে ছিলাম, সেখানেরই অনেকে সূর্যোদয় দেখতে ছেঁড়া দ্বীপে গিয়েছেন। তারা কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ভোররাতে চারটার দিকে রিসোর্ট থেকেই অটো করে যান। আবার সাতটার দিকে ফিরে আসেন।"
সেইসাথে, "আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে বারবিকিউ পার্টি, সবই চলছে," বলেন তিনি।
মিজ আহমেদ যেসব বিষয়গুলোর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছেন, এই একই সুরে কথা কথা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে সেন্টমার্টিন ঘুরে আসা আরও কয়েকজন।
কিছুদিন আগে বন্ধুদের নিয়ে সাদিয়া আফরিন গিয়েছিলেন সেন্টমার্টিন। তিনি বলেন, "দ্বীপে, মানে বাইরে সৈকতে বারবিকিউ করে না। তবে রিসোর্টে করা যায়।"
২০১৭ সাল থেকে ট্যুর অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী। প্রতিবছর তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের নিয়ে ভ্রমণে বের হন।
সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি গিয়েছিলেন সেন্টমার্টিনে। তার ভাষ্য, "এর আগেও আমি এখানে এসেছি। কিন্তু এবারের মতো এরকম বাজে অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি।"
"এখানে আগেও অনেক অনিয়ম হতো। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় আলাদা করে কিছু পরিবর্তন হয়নি। বরং, অনিয়ম যেন আরও বেশি হচ্ছে এখন। শিপে প্রচুর মানুষ, স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়ে যাচ্ছে।"
আর একসাথে অনেক দর্শনার্থী যাওয়ার কারণে নোংরাও বেশি হচ্ছে বলে জানান তিনি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, "প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। সেজন্য শিপে জার থেকে পানি নিয়ে খেতে হয়। অথচ সেন্টমার্টিন গিয়ে দেখবেন বোতল আর বোতল, পানিতে ভাসছে।"
তিনিও বলেন যে কোস্টগার্ডরা থামানোর চেষ্টা করলেও ছেঁড়াদ্বীপে অনেকেই যায়।