বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ০২:২২ অপরাহ্ন
                                           
ব্রেকিং নিউজঃ
দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ: ফয়জুল করিম চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সার্বিক নিরাপত্তায় নির্বিঘ্নে উদযাপিত হলো শোক র‍্যালি বান্দরবানে সেনা অভিযানে কেএনএফের দুই সদস্য নিহত, অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার শিক্ষার ভিত্তিতে — বেইজ লাইন সার্ভে ও ফিডব্যাক প্রক্রিয়ার রূপান্তরমূলক যাত্রা চট্টগ্রামে পবিত্র আশুরা উপলক্ষ্যে পুলিশের মতবিনিময় সভা: দিনের আলোয় শেষ করতে হবে তাজিয়া মিছিল..! বিদায় ঘন্টা বাজে—আরো এক দীপ্ত প্রদীপ নিভে গেল স্বাধীন দেশে নিরাপত্তাহীন মা-বোন: কোথায় আইনের শাসন? প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার পুনরায় সূচনা: মেধা যাচাইয়ে সরকারের স্মার্ট বিপ্লব সুদের টাকার জন্য ব্যবসায়ীর উপর হামলা “নৈতিক শিক্ষা হোক পাঠ্যসূচির অগ্রাধিকার, আগামীর জন্য গড়ি আদর্শ প্রজন্ম”

মহররম: রক্তজবাদের প্রতিশ্রুতি ও নৈতিক বিপ্লবের বার্তা

লেখক, জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

সময়ের নদী যখন হিজরি নববর্ষের কিনারায় এসে দাঁড়ায়, তখন তার ঢেউয়ে বয়ে আসে মহররমের নামে এক অদ্ভুত একাকিত্ব। এ মাস যেন কালের এক নিঃশব্দ আখ্যান, যে আখ্যানের প্রতিটি শব্দে লেখা আছে আত্মত্যাগের গাথা, প্রতিরোধের ইতিহাস এবং রক্তের দামে কেনা সততার সনদ। এ মাস শুধুই একটি তারিখ নয়—এ এক রূহানিয়াতের উদার খোলা জানালা, যেখান দিয়ে ঢুকে পড়ে ঈমান, একাগ্রতা আর ত্যাগের আলোকধারা।

পৃথিবীর সব পঞ্জিকাই সময়ের হিসাব রাখে, কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জিকার মহররম মাস সেই ব্যতিক্রম, যে ক্যালেন্ডার কেবল সময়কে মাপে না—তা মাপে আত্মত্যাগের পরিমাপ, নৈতিকতার মানদণ্ড। এ মাসে আসমানের দরজা খুলে যায় নীরব ধ্বনির মতো। বাতাসে ভেসে বেড়ায় কারবালার ধূলিকণার নিঃশব্দ ক্রন্দন।

মহররম—আল্লাহর মাস।
এমন এক মহান উপাধি, যা কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে স্বয়ং পরম প্রভুর ঘোষণা হিসেবে:
“নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মাসসমূহের সংখ্যা বারোটি, যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন; এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস।”
(সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৬)

এই চার মাসের অন্যতম মহররম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। তিনি বলেন—
“রোজা রাখার জন্য রমজানের পর সর্বোত্তম মাস হলো আল্লাহর মাস—মহররম।”
(সহিহ মুসলিম: ১১৬৩)

কী অপার্থিব এক উচ্চারণ—‘আল্লাহর মাস’। মহররমের এমন সুমহান মর্যাদা যেন শুধু সময়ের প্রাচীন রেখা নয়, বরং তা চেতনাকে আলোড়িত করে, জাগিয়ে তোলে নৈতিক বিপ্লবের চেতনা।

আশুরা—মহররমের দশম দিন। ইতিহাসের এক অলঙ্ঘনীয় প্রান্তর। একই দিনে কত অনন্য ঘটনাই না ঘটেছে! হযরত মূসা (আ.) তাঁর জাতিকে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দেন, নূহ (আ.)-এর কিশতিকে থামিয়ে দেয় ধরণী। আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হয়, হযরত ঈসা (আ.) আসমানে তোলা হন।

এই দিনটি সম্পর্কে প্রিয়নবী (সা.) বলেন:
“আশুরার দিনে রোজা রাখলে পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।”
(সহিহ মুসলিম: ১১৬২)

আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন উদারতায় মোড়ানো ক্ষমার ঘোষণা, যা আমাদের জীবনের ব্যর্থতায় নত মস্তককে আশার দীপ্তিতে উজ্জ্বল করে।

কিন্তু আশুরা মানেই কেবল ঐতিহাসিক স্মৃতি নয়; এর রক্তিম পটভূমিতে রয়েছে এক হৃদয়বিদারক আখ্যান—কারবালা।

কারবালা!
শব্দটি উচ্চারণ করতেই যেন দিগন্তরেখায় সূর্য থমকে দাঁড়ায়। নিসর্গ স্তব্ধ হয়। বালুরঙা প্রান্তরের বুকে গড়িয়ে পড়ে এক শিশুর তৃষ্ণার্ত কান্না, এক পিতার অটল দৃষ্টি, এক পরিবারের নিঃশেষ আত্মত্যাগ।

ইমাম হুসাইন (রা.)—নবীজি (সা.)-এর দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের নেতা, যে হৃদয় নবীর বুকের সাথে লেপ্টে ছিল। তাঁর জীবন কেবল আত্মমর্যাদার পাঠশালা নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের এক রক্তঝরা ব্যাখ্যা।

৬১ হিজরির মহররম। ইয়াজিদের স্বৈরশাসনের মুখে হুসাইন (রা.) মাথা নত করেননি। অন্যায়ের সাথে আপস নয়, বরং সত্যের জন্য জীবন বিসর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেন। স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি নিঃসন্তান শিশু আলী আসগরও কারবালার পাষাণ বুকে শহীদ হন। খোলা প্রান্তরে, তপ্ত মরুর মাঝখানে পিপাসিত মুখে, রক্তাক্ত হৃদয়ে ইমাম হুসাইন পৃথিবীকে এক চিরন্তন বার্তা দিয়ে গেলেন—আত্মত্যাগই প্রকৃত বিজয়।

কারবালার শোক শুধু ইতিহাস নয়, তা এক জীবন্ত শিক্ষা। প্রতিটি হৃদয়ে যদি হুসাইনের আত্মা জেগে ওঠে, তবে সমাজ থেকে মুছে যাবে অন্যায়, নিপীড়ন, দুর্নীতি। একবিংশ শতাব্দীর চেতনাবিহীনতার ভিড়ে হুসাইনের আদর্শ আমাদের আত্মা জাগিয়ে তোলে—জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কি সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে প্রস্তুত?’

নবীজি (সা.) হুসাইনের এই আত্মত্যাগকে পূর্ব থেকেই অনুধাবন করেছিলেন। একবার তিনি বলেন:
“হুসাইন আমার অংশ এবং আমি হুসাইনের অংশ। যে তাকে ভালোবাসবে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন।”
(তিরমিজি: ৩৭৮০)

হায়! কী হৃদয়বিদারক পরিণতি! হুসাইন শহীদ হন, কিন্তু সত্য শহীদ হয় না। কারবালার ধুলো রক্তে লাল হলেও, সেখান থেকে জন্ম নেয় চিরকালীন এক জ্যোতির্ময়তা। কারবালায় হুসাইন পরাজিত হননি, বরং সময়কে জয় করেছেন। দুঃসহ যন্ত্রণার মাঝে তিনি রচনা করেছেন এক আত্মিক বিপ্লবের ইতিহাস, যা কেবল শোক নয়, বরং অনুপ্রেরণার শিখা।

মহররম মানে শুধু তাজিয়া মিছিল নয়, বা রক্তাক্ত শরীর নিয়ে শোক পালন নয়—মহররম মানে আত্মনিরীক্ষা, নিজেকে প্রশ্ন করা: আমি কোন পথের যাত্রী? সত্যের না স্বার্থের? হুসাইনের না ইয়াজিদের?

আশুরার শিক্ষা তাই দ্বিমুখী। একদিকে রোযার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, অন্যদিকে কারবালার মাধ্যমে আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা। ইসলাম শুধু নামায-রোযা-হজ-যাকাতের ইবাদতে সীমাবদ্ধ নয়; তা এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ইবাদতেরই অংশ। হুসাইনের কারবালা সেই জীবন্ত শিক্ষা।

আধুনিক সমাজের প্রতিটি কোণে কোণে ইয়াজিদি মানসিকতার দাপট দেখা যায়—ক্ষমতার লালসা, ন্যায়ের বিপক্ষে মিথ্যার উল্লাস, দুর্বলকে পদদলিত করার সংস্কৃতি। এমন সমাজে হুসাইন যেন প্রজ্জ্বলিত এক বাতিঘর, যিনি শেখান—“তোমার তলোয়ার না থাকুক, তবুও ন্যায় পরিত্যাগ করো না।”

কারবালার একটি শিক্ষাও যদি সমাজে প্রতিফলিত হয়, তবে সমাজ বদলে যেতে পারে। হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ কেবল মুসলিম সমাজের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অনন্ত নৈতিক সংবেদনার নাম।

এই মহররম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ঈমান মানে শুধু আল্লাহকে মানা নয়—তা হলো সত্য ও ন্যায়ের জন্য নিজের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। আশুরার প্রতিটি মুহূর্ত যেন বলে ওঠে,
“তোমার জীবন এক কারবালা—তুমি কি হুসাইন হতে পেরেছ?”

আসুন, এই মহররমে আমরা শুধু চোখের অশ্রুতে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্তরকে রক্তাক্ত করি নৈতিকতায়। একবার অন্তত নিজের ভিতরের ইয়াজিদি প্রবৃত্তিকে চিনে নিই, এবং হুসাইন হয়ে ওঠার সাধনায় বুক বেঁধে যাই। শোক হোক শক্তির নামান্তর, এবং কারবালা হোক আমাদের প্রতিটি প্রতিবাদের রূহানী উৎস।

আজ আমরা যখন সমাজে সত্যবিমুখতা, ভোগবাদ ও আত্মমর্যাদাহীনতায় নিমজ্জিত, তখন হুসাইনের আদর্শ এক সাহসিক পথ দেখায়। মহররম আসে বারবার, কিন্তু আমাদের আত্মা কি প্রতিবার নবজীবনের দিকে হাঁটে?

এবারের মহররমে প্রতিজ্ঞা হোক—আমি কারবালাকে শুধু স্মরণ করবো না, বরং জীবনে ধারণ করবো। কারণ হুসাইন শুধুই ইতিহাসের চরিত্র নন, তিনি হলেন প্রতিটি বিবেকবান হৃদয়ের চিরন্তন প্রতীক।



ফেইসবুক পেইজ