✍️লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
ভালোবাসা একটি শব্দ, যার গভীরতা মাপার মতো কোনো মানদণ্ড নেই। মানবজীবনের সূচনালগ্ন থেকে এই অনুভূতি বহমান, নদীর স্রোতের মতো, কখনো শান্ত, কখনো উন্মত্ত। ভালোবাসা নিছক একটি দিন, একটি তারিখ, একটি ফুলের তোড়া বা চকোলেটের মোড়কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি হৃদয়ের নিভৃততম কোণে জেগে থাকা একটি চিরন্তন সুর, যা বাজে প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি সম্পর্কের টানাপোড়েনে। কিন্তু এই বিশুদ্ধ অনুভূতি বর্তমানে যেন একটি বাজারজাত পণ্যে পরিণত হয়েছে। সেই পণ্যের নাম ‘ভালোবাসা দিবস’।
যেখানে একসময় কবিগণ প্রেমের বিশুদ্ধতাকে উদযাপন করতেন মনের আঙিনায়, সেখানে আজ প্রেমের নামেই পালিত হয় কৃত্রিমতা, বাহ্যিক চাকচিক্য, আর বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে রঙিন বেলুন, চকোলেটের দোকান, কাঁচের প্রদর্শনীতে জ্বলজ্বল করা কার্ড সবই যেন এক বিষণ্ন হাসি হেসে বলে, "ভালোবাসা আজ এক নিখুঁত বিপণন কৌশল।" প্রেমের এই উদযাপন কি তবে এক গভীর ব্যঙ্গ নয় সেই অনুভূতির ওপর, যা ছিল হৃদয়ের নিভৃততম সত্য?
রবীন্দ্রনাথের প্রেমে ছিল আত্মার মুক্তি, জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম ছিল অপার্থিব এক শূন্যতার সঙ্গী। কিন্তু এখনকার প্রেমের গল্পগুলো যেন ইনস্টাগ্রামের ফিল্টার দিয়ে রঙিন করা, কিছুটা মেকি, কিছুটা ক্লান্ত। প্রেমের স্থায়িত্ব এখন রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসের উপর নির্ভরশীল, "ইন আ রিলেশনশিপ" থেকে "ইট’স কমপ্লিকেটেড" এ পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র কয়েকটি ক্লিক। এই ডিজিটাল প্রেমের জগতে হৃদয়ের ভাষা হয়তো হারিয়ে গেছে ইমোজির ভিড়ে।
এই দিবসের নামে সমাজের এক শ্রেণি যেন উদ্দামতাকে স্বাধীনতা ভেবে বসেছে। পার্কের নির্জনে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা কি সত্যিই প্রেম, নাকি তা শুধুই অদূরদর্শী আবেগের বহিঃপ্রকাশ? সেই প্রেম, যার ভিত্তি ভঙ্গুর, যার শেকড় নেই কোনো গভীরে, তা কি পারে কবিতার মতো অমর হতে? এমন প্রেমের গল্পগুলোই হয়তো শেষ হয় সংবাদ শিরোনামে, যেখানে ভালোবাসা রক্তে ভেজা, যন্ত্রণায় আঁকা।
ভালোবাসার শিক্ষা কি তবে এই? যে প্রেমে নেই আত্মার জ্যোতি, নেই দায়িত্ববোধ, তা কেবলই এক ক্ষণস্থায়ী প্রলোভন। সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, পরিবারের টানাপোড়েন, কিশোর-তরুণদের অন্ধ অনুকরণ সবই যেন ভালোবাসা দিবসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতা।
তবে কি প্রেম হারিয়ে গেছে? না, প্রেম হারায় না। প্রেম রয়ে গেছে সেই মায়ের চোখের কোণে, যে ভোরবেলা সন্তানের জন্য প্রার্থনা করে; রয়ে গেছে সেই বৃদ্ধ দম্পতির হাতে-হাত রাখা নীরব বন্ধনে। প্রেমের জন্য কোনো বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয় না। প্রেম প্রতিদিনের শ্বাস-প্রশ্বাসে, প্রতিটি ছোট্ট খেয়ালে, প্রতিটি নিঃশব্দ ভক্তিতে বেঁচে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
"ভালোবাসা অবিনশ্বর,
যেখানে হৃদয় নির্ভীকভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেয়।"
ভালোবাসা যদি সত্যিই হয়, তবে তা কেবল এক দিনের প্রদীপ নয়, তা একটি জীবনভর জ্বলে থাকা শিখা। আমাদের প্রয়োজন এই শিখাকে আবার খুঁজে বের করা, আবারও উপলব্ধি করা যে ভালোবাসা কোনো কার্ডের ভেতর আটকে থাকে না—ভালোবাসা বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীরে, নিরবধি, শাশ্বত।
লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো মিশর।