✍️লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
সাহরির পূর্বরাত: উৎসব, ইবাদত ও প্রাণচাঞ্চল্য
রমজান মানেই আত্মশুদ্ধির মাস, সংযমের মাস। কিন্তু মিশরের রমজান যেন ভিন্ন এক আবহ তৈরি করে। এখানে রাত নামলেই শহরজুড়ে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। শিশুরা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে, বাজি ফুটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, কেউবা খেলায় মগ্ন থাকে। এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হয় রমজানের রাত।
আমরা ছয়জন বন্ধু আল-আজহার মসজিদের পাশে দুটি ছোট রুমে থাকি। নিজেরাই রান্নার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছি। সাহরির জন্য রান্না আমরা রাতে, তারাবির নামাজের পরই সেরে ফেলি। এই অভ্যাস আমাদের সময় বাঁচায় এবং সাহরির জন্য তাড়াহুড়োর প্রয়োজন হয় না। রাতের গভীরতা যত বাড়ে, মিশরের আকাশজুড়ে যেন এক রহস্যময় পবিত্রতা নেমে আসে। শহর জেগে থাকে, মসজিদে মসজিদে কুরআনের তেলাওয়াত প্রতিধ্বনিত হয়।
ফজরের নামাজ শেষে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। কারণ, এখানে রাতের ঘুম বাংলাদেশ থেকে তুলনামূলকভাবে কম হয়। দিনের ব্যস্ততার জন্য শক্তি সঞ্চয়ের এটিই একমাত্র সুযোগ।
ইফতারের প্রস্তুতি: এক জান্নাতি উদ্যানের অভ্যর্থনা
দুপুরের নামাজের পর কিছুটা সময় কোরআন তেলাওয়াত করি। এরপর ইফতার করতে রওনা হই আল-আজহার মসজিদে। তবে এখানে ইফতার করতে হলে আগেভাগেই অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়। যদিও কেউ রেজিস্ট্রেশন না করলেও তেমন সমস্যা হয় না।
ইফতারের জন্য নির্দিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। আমরা দক্ষিণ পাশের রওয়াকুল আব্বাসিয়ার গেট দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করি। গেটের সামনে বিশাল লাইন—বিশেষত বিদেশি ছাত্রদের জন্য এটাই প্রবেশপথ। একে একে প্রবেশের পর আমাদের সামনে যেন এক জান্নাতি দৃশ্য খুলে যায়!
চারপাশের দেয়ালে কাঠ ও পাথরের নকশা করা অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী। খোলা ময়দানজুড়ে শ্বেতশুভ্র টাইলসের সৌন্দর্য। বারান্দায় বসে কেউ কোরআন তেলাওয়াত করছে, কেউবা তসবিহ পাঠ করছে। এ যেন এক অনন্য আধ্যাত্মিক পরিবেশ! মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ নানা দেশের শিক্ষার্থীরা এখানে ইফতার করতে আসে। সবাই নীরবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। দায়িত্বশীলরা নির্দেশনা দিচ্ছেন, আর স্বেচ্ছাসেবকরা খাবার সাজিয়ে দিচ্ছেন।
ইফতারের এক অনন্য সংস্কৃতি
ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে। আজানের ঠিক আগে সবকিছু প্রস্তুত হয়ে যায়। সবাই একসঙ্গে বসে অপেক্ষা করছে, কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য নেই, নেই কোনো বিশৃঙ্খলা।
আজান শুরু হতেই সবাই প্রথমে এক ঢোক পানি পান করে, তারপর দ্রুত নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে যেখানে ইফতার মানেই ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজু, সেখানে মিশরে ইফতারের এক ভিন্নতর স্বাদ। এখানে ইফতারে থাকে সিদ্ধ মুরগি, গরুর মাংস, রুটি বা ভাত—তবে রান্নায় নেই তেল, লবণ কিংবা অতিরিক্ত মশলার বাহুল্য। প্রথমবার খেতে গিয়ে স্বাদটা বিস্বাদ লাগলেও সময়ের সঙ্গে অভ্যাস হয়ে যায়।
নামাজ শেষে সবাই ধীরে সুস্থে বাকি খাবার শেষ করে। কেউ কেউ চুপচাপ বসে থেকে দোয়ায় মগ্ন হয়। এক পবিত্রতা, এক শৃঙ্খলা, এক অপার্থিব প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এই পরিবেশ, এই নিয়মশৃঙ্খলা, এই আধ্যাত্মিক প্রশান্তি—সবকিছু মিলে আল-আজহারের রমজান সত্যিই এক স্বর্গীয় অনুভূতি!
শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর